২২ শে ফেব্রুয়ারী ২০২১ ইং বিকেল ৪:৩০ টা।একটা জরুরী কাজে খুব তাড়াহুড়ো করে চাঁদপুরে যাচ্ছিলাম। তাই বাইকের স্পীডটা ও ছিল বেশ। বরদিয়া বাজার পেড়িয়ে যখন ডাকঘর পার হচ্ছি হঠাৎ করে বা পাশে দোকানের সামনে দাড়ানো একটি লোককেদেখে খুব পরিচিত মনে হল। ব্রেক কষে থামাতে থামাতে লোকটাকে পেছনে ফেলে কিছুটা সামনে এসে পড়েছি। গাড়িটা থামিয়েলোকটির দিকে তাকালাম, তিনিও আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। হ্যাঁ, এবার চিনতে পেরেছি, উনি মমিন ভাই। আগে দাঁড়ি ছিলনা। এখন, বেশ বড় দাঁড়িগুলো সাদা হয়ে গেছে।
২০১৬ সালে এনায়েতনগর, মতলব উত্তর, চাঁদপুর (মুন্সী আজিম উদ্দিন কলেজের সরাসরি সামনে, মাহমুদ সাহেবেরবাড়ির পূর্ব পাশে, ছোট রাস্তার সাথে দক্ষিনৃূখী ভবন) একটি মা ও শিশু হাসপাতাল নির্মাণের সাব-ঠিকাদার ছিলেন উনি।হাসপাতালের কাজ চলমান অবস্থায়- উনি স্থানীয় ঠিকাদার না হওয়ায়, এক বড় ভাইয়ের( Noman Dewan) সাথে সেই নির্মাণকাজ বন্ধ করতে গিয়ে সেদিন পরিচয় হয়েছিল মমিন ভাইয়ের সাথে। অত্যন্ত ভদ্র আর বিনয়ী আচরণ পেয়েছি তার কাছ থেকে।
সেদিন, আমরা যতই উগ্র আচরণ করছিলাম,
উনি চুপচাপ আমাদের ঝাড়ি- হুমকি- ধমকি বন্ধ হওয়া পর্যন্ত নির্বাক অপেক্ষা করছিলেন।
তখনই মনে হয়েছিল উনি অবশ্যই এমন বাস্তবতায় অভিজ্ঞ।
যা-ই হোক সেই বড় ভাই চলে গেলেন। তখন সাব-ঠিকাদার মমিন ভাই আমাকে চায়ের প্রস্তাব করলেন এবং ওনার কিছুপরিণতির কথা শোনালেন। নিজের কাজের বিষয়ে কোন অনুরোধ বা মীমাংসার ব্যাপারে কিছুই বলেননি তিনি।
কিন্তু ওনার কথাগুলো শুনে আমিই ওনাকে কাজের ব্যাপারে সর্বাত্মক সহযোগিতা করার কথা দেই।
এরপর মাস তিনেক প্রায় প্রতিদিন ই ওনার সাথে দেখা হয়- কথা হয়- আড্ডা হয়। মমিন ভাইয়ের বয়স আমার চেয়ে অন্তত১৮-২০ বছর বেশী। তারপরও মানুষটি আমার মনে বন্ধুর মতোই গেঁথে গিয়েছিল।
আমি বাইকে বসেই মমিন ভাই কে হাতে ইশারা করলাম আমার দিকে আসার জন্য। উনি কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে-ইরইলেন। তারপর উনি আমার দিকে আসতে লাগলেন। একি! উনি হাটতে পারছেন না!
বুঝতে বাকি রইল না, ভাইয়ের পরিণতি। হাটতে গিয়ে পড়ে গেলেন! আমি দ্রুত নেমে ভাইকে টেনে তুললাম। ততক্ষণেআশে পাশে কয়েকজন লোক চলে আসছেন। ওনাদের কাছে শুনলাম, মমিন ভাইয়েট স্ট্রোক হয়েছিল। আমি ভাইকে জিজ্ঞেসকরলাম, "এখন কেমন আছেন? আমাকে চিনতে পেরেছেন? "
ভাই মাথা নাড়লেন। তখন বুঝতে পারলাম, ভাই কথা বলার শক্তিটা ও হারিয়েছেন।
আবার জিজ্ঞেস করলাম, "কবে? কিভাবে? "
পকেট থেকে ভিজিটিং কার্ড আকারের ২০২০ সালের একটি ক্যালেন্ডার বের করে অক্টোবর মাসকে ছুয়ে বুঝিয়ে দিলেন মাসচারেক যাবত এই অবস্থা।
মমিন ভাই একহাতে আমাকে টেনে বুকে ধরে কি যে কান্না করলেন- আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। আমি কিছু না বলেইগাড়িতে উঠে, গাড়ি স্টার্ট করলাম। পেছন থেকে কাঁধে মমিন ভাইয়ের হাত। কাঁধ থেকে আমার মাথায় হাতটি দিয়ে কিসব যেনবলে যাচ্ছিলেন। কতভাবে কি কি যেন বুঝাতে চাচ্ছিলেন। আমি বুঝতে পারছিলাম নাহ্। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতেপারলামনা। ভাইয়ের হাতটা ধরে নিজের মতো করে কিছু কথা বলে চাঁদপুরের দিকে অগ্রসর হতে লাগলাম।
--- পুরোটা রাস্তা-ই আনমনে ছিলাম। ---
আসলে মানুষের ভালো থাকার কোন নিশ্চয়তা নেই। কেউই বলতে পারবেনা কতটুকু বয়স পর্যন্ত কতটুকু নিরাপদ আরস্বাচ্ছন্দ্যে কাটাতে পারবে। বয়স বেশী বলেই সে পরাধীনতায় অগ্রগামী?- এর কোন গ্যারান্টি নেই।
আজ মমিন ভাই নিজের কষ্ট-অনুভূতি-আকাঙ্খা বোঝাতে পারছেন না। তিনি বলার শক্তি হারিয়েছেন। এ যে কত কষ্টের, কত যন্ত্রণার- তা আমরা বুঝতে পারার কথা নয়।
---
আবার, কিছু মানুষ হয়তো এরচেয়ে ও অনেক বেশী যন্ত্রণা ভোগ করছে, যারা কথা বলার ক্ষমতা থেকেও বলার মতোপরিস্থিতি হারিয়েছেন।
একই রক্তের মানুষগুলো চারপাশে থাকার পরও- নিজেকে বুঝার মতো- ব্যথা আর একাকীত্বের সঙ্গী যারা খুঁজে পায়না।
যারা নিজ মানুষদের রঙ্গ- মঞ্চে র ঠাট্টা থেকে বাঁচতে বাড়ি ফিরতে চায় না।
যারা নিজের প্রতি যত্নের কোনও কারন খুঁজে পায়না।
যারা শত অসুস্থ্যতা- অনিশ্চয়তার মধ্যে ও চেয়ে থাকে কোন সহমর্মিতার দিকে। নিজেকে নিয়ে নয়, যার কাছে সে অভিশপ্ত- তারই মহিমার কাঙ্গাল হয়ে গোপনে, নীরবে কাঁদে।
স্বর না হারিয়ে ও যারা নির্বাক!
তারা হয়তো মমিন ভাইদের চেয়েও অনেক বেশী দূঃখী।
লেখক,
মুহাম্মদ রাসেল সরকার।
ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব
সাহেববাজার, ফতেপুর পূর্ব, মতলব উত্তর, চাঁদপুর।
0 Comments